32.1 C
Khulna
Tuesday, August 5, 2025

খুলনায় দুই দিনে তিন প্রাণহানি, হত্যাকারীরা অধরা

খুলনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে গেছে তিনটি হত্যাকাণ্ড ও এক যুবককে গুলি করার ঘটনা। একাধিক ঘটনায় মোটিভ স্পষ্ট হলেও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এখনো অধরাই থেকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চললেও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সাফল্য নেই। এর ফলে নগরবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে।

নিজ বাড়িতে ছুরিকাঘাতে খুন মনোয়ার টগর

গত ১ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) রাতে সোনাডাঙ্গা থানাধীন সবুজবাগ এলাকায় নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হন মনোয়ার হোসেন টগর (২৮)। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেদিন রাত ৯টার কিছু পর তিনটি মোটরসাইকেলে করে সাতজন যুবক টগরের বাড়ির সামনে এসে দরজায় নক করে। তারা টগরের সঙ্গে ৪–৫ মিনিট কথা বলার পর হঠাৎ বুকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

পরবর্তীতে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে পুলিশের সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা সম্ভব হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। নিহতের বাবা জামাল হাওলাদার থানায় ৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৪–৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সোনাডাঙ্গা থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, নিহত টগরের স্ত্রী জানান তিনি একসময় গ্রেনেড বাবুর ‘বি’ কোম্পানিতে যুক্ত ছিলেন। পরে পলাশ-কালা লাভলুর গ্রুপে যোগ দেন। মাদকের লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেই পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

স্ত্রীর প্রথম স্বামীর হাতে খুন আলামিন

একই রাতের শেষ দিকে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে স্ত্রী রিপার প্রথম স্বামী আসাদুলের হাতে খুন হন ভ্যানচালক আলামিন সিকদার (৩৩)। পুলিশ জানায়, স্ত্রীকে নিয়ে বিরোধের জেরে ভোরে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

দিঘলিয়া থানার ওসি এইচ এম শাহীন বলেন, আলামিনের ভাই বাদী হয়ে আসাদুলসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। আসাদুল ঘটনার পরপরই পালিয়ে গেছে। তাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সেলুনের সামনে গুলিবিদ্ধ যুবক

রবিবার রাত ৭টা ৪৫ মিনিটে নগরীর ২ নম্বর কাস্টমঘাট এলাকার একটি সেলুনের সামনে অবস্থান নেওয়া যুবক সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। চারটি মোটরসাইকেলে করে আসা মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলির একটি সোহেলের পেটে বিদ্ধ হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি বলে জানান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আবু তারেক। তিনি বলেন, “আমরা নানা সূত্র থেকে তথ্য নিচ্ছি, সেগুলো যাচাই করে অভিযান চালানো হচ্ছে। শহরের নিরাপত্তা জোরদারে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।”

চলন্ত মোটরসাইকেলে গলাকাটা, নিহত মাছের ঘের ব্যবসায়ী

রবিবার রাতেই মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়া এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেলে থাকা অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলাকেটে হত্যা করা হয় মাছের ঘের ব্যবসায়ী আলামিনকে। ১২ ঘণ্টা পার হলেও পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী জানান, নিহতের ভাই আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন। এলাকাবাসীর বরাতে তিনি বলেন, আলামিন আগে মহেশ্বরপাশায় থাকলেও বর্তমানে বাদামতলায় বসবাস করতেন। সম্প্রতি তিনি একটি মাছের ঘের লিজ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

ওসি আরও জানান, ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো কার্যকর সিসি ক্যামেরা না থাকায় অপরাধীদের শনাক্তে সমস্যা হচ্ছে। তবে পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান চালাচ্ছে।

সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতা, উদ্বেগে নাগরিক সমাজ

সম্প্রতি খুলনায় একের পর এক খুন, ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী জেল থেকে বের হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশ প্রশাসনের মনোবল ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।”

পুলিশের যুক্তি: একার পক্ষে সম্ভব নয়

অন্যদিকে কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেন, “এসব ঘটনা মূলত টার্গেট কিলিং। পুলিশের একার পক্ষে সব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠালেও দুর্বল বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সন্ত্রাসীরা সহজে জামিন পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়াচ্ছে।”

উপসংহার: উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে খুলনা

একদিকে হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর তৎপরতার অভাব প্রকট হয়ে উঠছে। নাগরিকদের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও হতাশা। খুলনায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

- Advertisement -spot_img

More articles

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ