প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫
জুলাই বিপ্লবের পর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) হাজারো নেতা-কর্মী। দলটির সাবেক মন্ত্রী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও আছেন এ তালিকায়। তবে যে হারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, প্রায় একই হারে আদালত থেকে তারা জামিনও পাচ্ছেন। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পুলিশ প্রশাসন। তাদের আশঙ্কা—এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪৩ হাজার ৩০২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী।
গ্রেপ্তারের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে—জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, বিপ্লব-পরবর্তী সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, ঝটিকা মিছিল করে লিফলেট বিতরণ ও পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবন।
তবে একই সময়ে ৩১ হাজার ২৭২ জন জামিন পেয়েছেন, যেখানে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে—অসুস্থতা, বার্ধক্য ও দলীয় পদে সক্রিয় না থাকা।
রেঞ্জভিত্তিক গ্রেপ্তার ও জামিনের পরিসংখ্যান
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে—
ঢাকা মহানগরীতে (ডিএমপি) গ্রেপ্তার ২,৮১২ জন; জামিন পেয়েছেন ২,২১২ জন।
ঢাকা রেঞ্জে গ্রেপ্তার ৬,৯২৩ জন; জামিন ৪,৬১২ জন।
রাজশাহী রেঞ্জে গ্রেপ্তার ৪,৯৩৩ জন; জামিন ৩,৯৯৮ জন।
খুলনা রেঞ্জে গ্রেপ্তার ৫,৯০১ জন; জামিন ৪,৬১২ জন।
বরিশাল রেঞ্জে গ্রেপ্তার ১,৫১২ জন; জামিন ১,৪৩৩ জন।
রংপুর রেঞ্জে গ্রেপ্তার ৩,৫৯১ জন; জামিন ২,৪১৪ জন।
ময়মনসিংহ রেঞ্জে গ্রেপ্তার ২,৯৬৬ জন; জামিন ১,৩৪৩ জন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জে গ্রেপ্তার ৭,৫২৩ জন; জামিন ৫,৮১৩ জন।
সিলেট রেঞ্জে গ্রেপ্তার ১,২৯৮ জন; জামিন ৯৮০ জন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্বেগ
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক আসামি ফৌজদারী মামলারও অভিযুক্ত। কারও বিরুদ্ধে হত্যা, গুলি, হামলা বা আন্দোলন দমনে পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
> “এরা সবাই আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। গত ১৫ বছরে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিতে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা এভাবে জামিনে বের হলে আবারও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, “ফ্যাসিবাদের দোসররা গণহারে জামিন পেলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে,” যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে।
জামিন বাণিজ্যের অভিযোগ
বিভিন্ন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেমন পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, তেমনি কিছু সুবিধাবাদী আইনজীবীও ‘জামিন বাণিজ্যে’ জড়িয়ে পড়েছেন। তারা অর্থের বিনিময়ে অভিযুক্ত আওয়ামী নেতা-কর্মীদের জামিনে সহযোগিতা করছেন। জামিনপ্রাপ্তদের মাধ্যমে আবার নতুন আসামিদেরও তাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের মত
ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন,
> “বর্তমানে জামিনের হার প্রায় শূন্য। তবে যাদের দলীয় পদ নেই, বয়স বেশি বা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, তারা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন,
> “ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে। পরাজিত গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তাই অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করে জামিনসহ আইনি অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
পুলিশ সদর দপ্তরের অবস্থান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন,
> “আদালত থেকে ফ্যাসিস্টরা কেন জামিন পাচ্ছে, সেটি আমরা বিশ্লেষণ করছি। সামনে জাতীয় নির্বাচন রয়েছে। এরা মুক্তি পেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।”