31.7 C
Khulna
Tuesday, July 15, 2025

আপন ভাই ক্যামনে আমার সংসার তছনছ কইরা দিলো!

নির্মম হত্যাকাণ্ডে কেঁপে উঠেছে ময়মনসিংহের ভালুকা। একটি বাসা থেকে একসঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে এক মা ও তার দুই শিশুসন্তানের গলাকাটা মরদেহ। নিহতরা হলেন—ময়না আক্তার (২৫), তার মেয়ে রাইসা (৭) ও ছেলে নিরব (২)। সোমবার (১৪ জুলাই) সকালে ভালুকা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের টিঅ্যান্ডটি রোড এলাকার ভাড়া বাসা থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন নিহতদের দেবর নজরুল ইসলাম। পরিবারের দাবি, হত্যাকাণ্ডের পেছনে তিনিই দায়ী।

কী ঘটেছিল সেই রাতে?

রফিকুল ইসলাম রাত ৭টা ৪০ মিনিটে নাইট শিফটে ডিউটি করতে বাসা থেকে বের হন। যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বলেন, বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে। কিছুক্ষণ পর বাচ্চারা কান্নাকাটি করে তার পিছু নেয়। তিনি তাদের ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে ডিউটিতে চলে যান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা মনে হলে ফোন করেন, কিন্তু স্ত্রীর মোবাইল বন্ধ পান। পরে ছোট ভাই নজরুলের ফোনে যোগাযোগ করেন। নজরুল জানায়, সে বাসায় আছে। পরে নজরুলের ফোন থেকেই স্ত্রী ময়নার সঙ্গে কথা হয়। ময়না জানায়, মোবাইল বন্ধ ছিল না, ভিডিও দেখছিল। তারপর ঘুমাতে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

সকালে কী দেখলেন রফিকুল?

পরদিন সকাল ৮টার দিকে ডিউটি শেষে রফিকুল বাসায় ফিরে দেখেন বাইরে থেকে দরজা তালাবদ্ধ। ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। ঘরে ঢুকেই স্ত্রীর ও দুই শিশুসন্তানের রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পান।

তিনি বলেন, “আমার ভাই নজরুল আগেও একটি হত্যা মামলার আসামি ছিল। আড়াই মাস আগে কষ্ট করে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলাম। এরপর সে এক মাস ধরে আমাদের বাসায় ছিল। এখন সে পলাতক। সে যদি না মারত, তাহলে পালাত কেন? আমার সংসারটা সে একেবারে শেষ করে দিল।”

নিহতের স্বজনদের ভাষ্যে কি বোঝা যায়?

নিহত ময়নার খালাতো বোন সালমা আক্তার জানান, ময়না তাকে কয়েকবার দেখা করার জন্য বলেছিলেন। বলেছিলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান। তিনি বলেন, “আসা হয়নি, না আসার কষ্ট এখন পাহাড়সম। বাচ্চাগুলোর গলায় কীভাবে ছুরি চালাতে পারল নজরুল?”

এলাকাবাসী ও পুলিশের প্রাথমিক ধারণা

নিহত রফিকুলের পরিবার নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কীর্তনখোলা গ্রামের বাসিন্দা। দুই ভাইয়ের মা মারা গেছেন অনেক আগেই, আর বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। ছোটবেলায় দুই ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তাদের লালনপালন করেন এক ফুফু, যিনি ভিক্ষা করতেন।

বাসাটির মালিক হাইয়ুম হাসান বলেন, দেড় মাস আগে রফিকুল তার বাসা ভাড়া নেন। দুই রুমে ভাগ হয়ে তারা থাকতেন—একটিতে পরিবার, আরেকটিতে নজরুল। তাদের মধ্যে কখনও বিরোধ চোখে পড়েনি।

ভালুকা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনতোষ সাহা বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, পারিবারিক কলহ থেকেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ঘর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।”

ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, “রফিকুলের সংসারে অভাব-অনটন ছিল। স্ত্রী-সন্তানদের খরচ নিয়ে সমস্যা চলছিল। ৪০ হাজার টাকা সুদে ঋণ নিয়ে রফিকুল তার ভাই নজরুলকে আগের একটি হত্যা মামলায় জামিনে মুক্ত করেছিলেন। ধারণা করছি, নজরুলই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সকাল ৬টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় এবং মোবাইল ফোন বিক্রির চেষ্টা করে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হবে।”

মামলা ও তদন্ত

নিহতের ভাই মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। নজরুলকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।

একটি অসহায় পরিবারের শেষ আশ্রয়টুকুও শেষ করে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এক আত্মীয়—এ যেন বাস্তবের এক বিভীষিকাময় গল্প। পুলিশের তদন্তে হয়তো জানা যাবে কেন ঘটল এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। তবে ততক্ষণে নিঃশেষ হয়ে গেছে এক মা আর তার দুটি শিশুর ভবিষ্যৎ।

- Advertisement -spot_img

More articles

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ