হাত-পা ভাইঙা দিলেও ছেলেটারে জীবিত দেখবার পাইতাম। আমি বুড়া হইয়া গেছি, আমার মৃত্যুর আগে সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেটারে খুন কইরা দুনিয়া থেকে বিদায় কইরা দিলো। আমার অন্তরটা ফাইট্টা যাইতাছে। আমি কেমনে বুঝাই, বাবা হয়ে এ কষ্ট কতটুকু।’ ছেলে হারানোর শোকে আহাজারি করতে করতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের বাবা হাসান জামাল।
তুহিনের বাবার বুকফাটা আর্তনাদে যেন ফুলবাড়িয়া পূর্ব ভাটিপাড়া গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কেবল তার পরিবার নয় পুরো এলাকাবাসী শোকে মুহ্যমান।শুক্রবার দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার পূর্ব ভাটিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তুহিনের মৃত্যুর খবরে তার বাবা মো. হাসান জামিল বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পুত্রশোকে তার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
জামিল জানান, গত পরশুদিনও তুহিন তার জন্য ওষুধ কেনার জন্য এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। এখন কে তার জন্য ওষুধ পাঠাবে, কে তার অসুস্থতার খোঁজ নেবে, এই ভেবে তিনি অস্থির।তুহিনের মা সাহাবিয়া খাতুন আহাজারি করে বলেন, দুই নাতির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার পর তার আদরের ছেলের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবারে কারা মারলো? কী দোষ তার? তোমরা আমার বাবারে আইনা দাও। আমি তোমাদের কাছে কিছু চাই না, শুধু আমার বাবারে এক নজর দেখতে চাই।’
তিনি জানান, তুহিন তাকে চোখের অপারেশন করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখন তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেছে।
তুহিনের বড় বোন রত্না বেগমও ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে ছুটে এসেছেন। মাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে কোলে করে বড় করেছি। কেন তাকে এমন নির্মমভাবে মরতে হলো? সে তো কারো ক্ষতি করেনি। যারা আমার ভাইকে মেরেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তুহিন ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ এবং ভালো মনের মানুষ। তিনি কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতেন না। সাংবাদিকতার পাশাপাশি ব্যবসা করতেন তিনি। তার বড় ভাই জসিম উদ্দিন ২০০৯ সালে ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখাশোনার মূল দায়িত্ব ছিল তুহিনের ওপর।
স্থানীয় ব্যাবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ‘তুহিন অনেক বছর ধরে গাজীপুরে সাংবাদিকতা করত। গতকাল যখন তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর পাই, তখন এলাকার সবাই মর্মাহত হয়েছি। তুহিনের বৃদ্ধ বাবা-মা এই খবর জানার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আমরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
তুহিনের ভাগ্নে আবু রায়হান বলেন, ‘মামা ভালো মানুষ ছিলেন। যারা তুহিন মামাকে মেরেছে, তারা মানুষ নয়, অমানুষ। এমন করে কোনো মানুষকে কেউ মারতে পারে না। আমরা তার খুনিদের ফাঁসি চাই।’তুহিন প্রায় দুই দশক ধরে গাজীপুরে বসবাস করছিলেন। তিনি ২০০৫ সাল থেকে গাজীপুরের চান্দানা চৌরাস্তা এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং ‘দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের চান্দানা চৌরাস্তা মোড় এলাকায় দুর্বৃত্তরা তুহিনকে জনসম্মুখে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে।
তুহিনের মরদেহ গাজীপুর চৌরাস্তায় প্রথম জানাজার পর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আজ বাদ আছর উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খাইরুল আলম রফিক এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি সমকালকে বলেন, আমাদের একটাই চাওয়া- তুহিনের খুনিদের উপযুক্ত শাস্তি হোক, যাতে আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়। তুহিনের মৃত্যুতে সারা দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।