একসময়ের শান্তির শহর খুলনা বর্তমানে যেন আতঙ্কের এক জনপদ। কুপিয়ে ও গুলি করে মানুষ হত্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সন্ধ্যা হলেই নগরবাসীর মনে ভর করে অজানা আতঙ্ক। গত এক বছরে খুন হয়েছে ৩১ জন। এর মধ্যে শুধু মাদক বিক্রি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বে হত্যার শিকার হয় ১১ জন। নগরীর পাড়া-মহল্লাগুলোয় জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মাদক কারবারিরা।
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জনবল ও যানবাহনের অভাবে খুচরা মাদক বহনকারী গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের কার্যক্রম। যদিও গ্রেপ্তার হওয়া এসব মাদক কারবারিও দ্রুতই জামিনে বের হয়ে ফের একই কাজে জড়াচ্ছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলার দ্রুত অবনতিশীল এই পরিস্থিতিতে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় নাম উঠবে খুলনার। একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে থাকলেও অধরা জড়িতরা। গত ১১ জুলাই নগরীর মহেশ্বরপাশায় নিজ বাড়ির সামনে খুন হন বহিষ্কৃত যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা। মৃত্যু নিশ্চিতে গুলির পর তার পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা আবদুল করিম মোল্লা অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে মামলা করেন। ঘটনাস্থলের পাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা হলেও বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।গত বছরের ২ নভেম্বর রাতে নগরীর আলকাতরা মিল এলাকায় গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় আশিকুর রহমান রাসেলকে। এলাকায় ছিলেন পঙ্গু রাসেল নামে পরিচিত। এ ঘটনায় নিহতের বোন মাজেদা বেগম বাদী হয়ে ১২ জনের নামে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা করেন। এই মামলার এজাহারভুক্ত চারজনসহ সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এসআই মানজুর হাসান বলেন, রাসেল মাদক কারবারে জড়িত ছিল। প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে খুন হয়।গত ২৯ নভেম্বর রাতে নগরীর টুটপাড়ায় সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর জখম করে। তিনি ৪ ডিসেম্বর মারা যান। এ ঘটনায় আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক, তার ভাই সজীবসহ ৯ জনের নামে সদর থানায় মামলা করেন নিহতের ছোট ভাই আবদুল্লাহ মোল্লা। তিনি বলেন, ‘আশিক নাকি ভারতে। তার নির্দেশে এলাকায় এখনও সন্ত্রাস হচ্ছে।’
একইভাবে গত ৩ আগস্ট রাতে মহেশ্বরপাশার উত্তর বণিকপাড়া এলাকায় আলামিন হাওলাদারকে কুপিয়ে, ১৮ ডিসেম্বর হাজী মহসীন রোডে কুপিয়ে ও গুলি করে রংমিস্ত্রি সোহেল, গত ২৪ জানুয়ারি রাতে নগরীর তেঁতুলতলা মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণবকে কুপিয়ে ও গুলি করে, ১৫ মার্চ রাতে চরমপন্থি নেতা বড় শাহীনকে গুলি করে, ২৬ মে মেট্রোপলিটন কলেজের সামনে গোলাম হোসেনকে কুপিয়ে, ৪ জুন নগরীর সোনাডাঙ্গার ময়লাপোতা এলাকায় ছুরি মেরে সবুজ হাওলাদার এবং ১ আগস্ট ঘরে ঢুকে ছুরি মেরে মনোয়ার হোসেন টগরকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় হওয়া মামলার বেশির ভাগ আসামি ধরা পড়েনি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য বলছে, গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে খুলনায় অন্তত ৩১টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে যে সংখ্যা ছিল ১৯টি। এ ছাড়া গুলি করে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনাও ঘটেছে শতাধিক। গত এক বছরের ৩০টি হত্যা মামলায় ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে ১২টি মামলার আসামিরা আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।এসব জবানবন্দি বিশ্লেষণ ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদক সংক্রান্ত বিরোধ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেশি খুনোখুনি হয়েছে। ১১টি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে মাদক ও সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্যের বিরোধের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টির সঙ্গে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবু, শেখ পলাশ ও আশিক গ্রুপের সদস্যরা জড়িত। একটির সঙ্গে হাড্ডি সাগরের অনুসারী ও দুটি হত্যাকাণ্ডে নগরীর দৌলতপুরের চরমপন্থি গোষ্ঠীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
কেএমপির কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ‘২৭টি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এজাহারভুক্ত বেশির ভাগ আসামি কারাগারে। নগরীর একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরা হয়েছে। অপরাধ কমাতে টহল বৃদ্ধি ও জনগণকে সচেতনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে।’
যানবাহন-জনবল সংকটে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয় গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত সময়ে মোট অভিযান চালিয়েছে ১৮৮১টি। এসব অভিযানের সময় অপরাধ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আসামি করা হয়েছে ৪২৯ জনকে। গত বছরের আগস্টের ৮টি অভিযানে আসামি ৩ জন, সেপ্টেম্বরের ১০৫টি অভিযানে আসামি ২৩, অক্টোবরের ১৬৪টি অভিযানে আসামি ৪৭, নভেম্বরের ১৬৬টি অভিযানে আসামি ৩৭ এবং ডিসেম্বরের ১৭০টি অভিযানে আসামি ছিল ৪৬ জন।
আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৭৫টি অভিযানে আসামি ৪১ জন, ফেব্রুয়ারির ১৪৭টি অভিযানে আসামি ২৮, মার্চের ১২২টি অভিযানে আসামি ৩৮, এপ্রিলের ২০৬টি অভিযানে আসামি ৪১, মে মাসের ২০৭টি অভিযানে আসামি ৪৫, জুনের ২০৬টি অভিযানে আসামি ৪২ এবং জুলাইয়ের ২০৫টি অভিযানে ৩৮ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়।
২৬ লাখের বেশি জনসংখ্যার নগরী খুলনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসে রয়েছে মাত্র দুটি গাড়ি। ফলে চরম বিড়ম্বনা ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে এই দপ্তর এবং অধীন দুটি সার্কেলের অভিযান ও মনিটরিং কার্যক্রম। এ ছাড়াও দপ্তরটিতে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদ রয়েছে শূন্য।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনা জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার নয়টি উপজেলা ও মহানগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি গাড়ি। যানবাহনের অভাবে অনেক সময় অভিযানে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। ভাড়া গাড়িতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন কর্মকর্তারা।কর্মকর্তারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক অভিযানে যেতে হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে। ভাড়া গাড়িতে যাওয়ায় ঝুঁকি থাকে। সাধারণ মানুষ সরকারি দপ্তরের বুঝতে না পেরে হেনস্তাও করে। একটি গাড়ি অভিযানে গেলে অন্যটি অফিসের ব্যবহারের জন্য রাখতে হয়। সব মিলিয়ে নগরীর একদিকে অভিযান চালাতে গেলে অন্যদিকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
অধিদপ্তরের খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘জনবল সংকট থাকলেও কোনোমতে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে; কিন্তু যানবাহন সংকটে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। মাদক চোরাকারবারির খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান না চালালে পরে তাদের আর ধরা যায় না।’NS: কালবেলা