প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৫
দেশের স্বল্পমেয়াদি জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এলপিজির (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) দাম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, বর্তমানে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১২০০ টাকার বেশি হওয়ায় শিল্প ও গৃহস্থালি ব্যবহারকারীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন, অথচ এর দাম এক হাজার টাকার মধ্যে হওয়া উচিত।
শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে এলপিজি: অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে তিনি এ কথা বলেন। টেকসই এলপিজি অর্থনীতি গড়ে তোলা, পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলা এবং নিরাপত্তা জোরদারের লক্ষ্যে এ কনক্লেভের আয়োজন করে দৈনিক বণিক বার্তা।
জ্বালানি উপদেষ্টা জানান, বাজারে বাড়তি দামে এলপিজি বিক্রি বন্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, “এক হাজার ২০০ টাকার সিলিন্ডার ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে—এটার দায় নিতে হবে ব্যবসায়ীদের। দায়-দায়িত্বহীন ব্যবসা চলতে পারে না। অতিরিক্ত মুনাফা করে বিদেশে সম্পদ পাচার করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “গ্যাস খাতে অসংখ্য অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে, জ্বালানি নিশ্চিত না করেই চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব অপকর্ম করেছেন এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ীরা।”
দেশে জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার বিষয়েও তিনি জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)-এর জন্য নতুন রিগ কেনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এখনো সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। এজন্য বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে বলে জানান উপদেষ্টা।
বিএনপি ও বিইআরসির পাল্টা মন্তব্য
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, “সবাইকে দোষারোপ করে সমাধান আসবে না। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে—এখনই বিকল্প জ্বালানি পরিকল্পনা নিতে হবে।”
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, “উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে এলপিজি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ভোক্তা যাতে কম দামে গ্যাস পায়, সে জন্য ডলার দর ও সৌদি আরামকোর মূল্য ধরে প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।”
গবেষণা ও প্রবন্ধ
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ম. তামিম। প্রবন্ধে তিনি জানান, দেশে প্রতিদিন প্রায় ১৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এলপিজি খাতে দিনে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও মজুত সীমিত। শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহার করলে ৩৫–৪০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় সম্ভব।
নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা পরিস্থিতি
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানান, এ বছর গ্যাস খাতে দেড় হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে ৫৮০টি এলপিজি-সংক্রান্ত। তিনি বলেন, “প্রশিক্ষণ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।”
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, “বিইআরসি দাম নির্ধারণ করে। সরকার নীতিগত সহায়তা দিলে আমরা প্রতিযোগিতামূলক বাজার বজায় রাখতে পারব।”
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, “উপদেষ্টা যদি ৭ শতাংশ মুনাফা ধরে এক হাজার টাকায় এলপিজি বিক্রি সম্ভব মনে করেন, তাহলে নিজেই সেই দামে বিক্রি করে দেখান।”
অংশগ্রহণ ও আলোচনা
কনক্লেভে উপস্থিত ছিলেন বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, ইস্টার্ণ ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার, ইউনাইটেড আইগ্যাস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হারুন গুরতাচ, পেট্রোম্যাক্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মার্কো অ্যান্টোনিও রড্রিগেজ, আকিজ বশির গ্রুপের সিওও মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রমুখ।
এলপিজি খাতের ভবিষ্যৎ নীতিমালা প্রণয়ন, নিরাপত্তা মানদণ্ড, বাজার কাঠামো, পরিবেশগত টেকসইতা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় অনুষ্ঠানে। সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তা সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।