Home জাতীয় ইডিসিএলে দুর্নীতি-অনিয়ম: এমডি পরিবর্তনের পরও থামেনি নিয়োগ বাণিজ্য ও ছাঁটাই বিতর্ক

ইডিসিএলে দুর্নীতি-অনিয়ম: এমডি পরিবর্তনের পরও থামেনি নিয়োগ বাণিজ্য ও ছাঁটাই বিতর্ক

0

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ওঠে টেন্ডার বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ আর্থিক লেনদেন, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন, অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে লোক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ।

দুর্নীতির প্রমাণসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-ও সময় সময় তদন্তে নামে। কিন্তু ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পরিবর্তনের পরও এসব অনিয়ম বন্ধ হয়নি। বরং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) আমলেও নতুনভাবে নিয়োগ বাণিজ্য ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠে এসেছে।

সাবেক এমডির বিরুদ্ধে ৪৭৭ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

২০১৪ সালে ইডিসিএলের এমডি হিসেবে নিয়োগ পান আওয়ামীপন্থী চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের নেতা ডা. এহসানুল কবির। দুদকে তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৪৭৭ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ। শুরুতে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পেলেও প্রায় ১০ বছর পদে বহাল ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের আগস্টে সরকারের পতনের পর তিনি পদত্যাগ করেন।

অনিয়ম আর দুর্নীতির কাজে তাকে সরাসরি সহায়তা করছে তারই গড়ে তোলা পুরোনো সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন খুলনা এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্লান্টের উপ-ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ (হিসাব ও অর্থ) কাজী তানজীমা তাবাচ্ছুম (২৩৪৯)। তার হাত ধরেই সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন মনিরুল। গোপালগঞ্জ কোটায় চাকরি পাওয়া তাবাচ্ছুমকে সঙ্গী বানিয়ে অনৈতিকভাবে ওভারটাইম সুবিধা দেওয়াসহ বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। খুলনা প্ল্যান্টে তাবাচ্ছুমের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা খাদিজা আফরিন (৩৭১২), সহকারী কর্মকর্তা (প্রশাসন) শেখ মিজানুর রহমান (৪৬৭৮), কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (নিরপেক্ষ) সুজিত কুমার মণ্ডল (৪১০১), কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (প্রশাসন) অনন্যা ইউসুফ (২৩১৬), মো. আশিকুজ্জামান (৪৯০৭), সোনিয়া সুলতানা (৩৭০৪), শাপলা খাতুন (০৬২৮) ও গাড়িচালক কামাল হোসেন।

খুলনা প্ল্যান্টে চাকরিচ্যুতদের একজন হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অতিরিক্ত জনবল দেখিয়ে ১০ এপ্রিল আমাদের চাকরিচ্যুতির নোটিশ দেওয়া হয়। অথচ চাকরিচ্যুত করা হয় ২০ মার্চে। ওখানে সবকিছু চলে প্রতিষ্ঠানটির গাড়িচালক সিবিআই নেতা কামাল হোসেনের কথায়। এমনকি তাকে টাকা দিয়ে অনেকেই এখন নিজের চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন। এই প্ল্যান্টে যত মালি, ক্লিনার সবই তার তদবিরে নিয়োগ দেওয়া। আর এসব তিনি করছেন মনিরুল ইসলামের ইশারায়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা নতুন এমডি সামাদ মৃধা, কিন্তু পুরনো অনিয়মই বহাল

তার স্থলাভিষিক্ত হন দ্বৈত নাগরিকত্বধারী মো. সামাদ মৃধা, যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে জানুয়ারিতে ইডিসিএলের দায়িত্ব নেন। শুরুতে “দুর্নীতিমুক্ত সংস্কারক” হিসেবে আগমন ঘটলেও অল্প সময়েই তার বিরুদ্ধে নিজের আত্মীয়দের নিয়োগ, নিয়োগ বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম এবং ছাঁটাই নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্তে মন্ত্রণালয় একটি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

আত্মীয় নিয়োগ ও পদোন্নতির অভিযোগ

সামাদ মৃধা দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র চারদিনের মধ্যে তার ভাতিজা নাজমুল হুদাকে নিয়োগ দেন সিনিয়র অফিসার ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। কয়েকদিন পরই তাকে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি ম্যানেজার করা হয়। একইভাবে একজন ডিআইজি কর্মকর্তার ভাতিজা শাফায়াত হোসেন-কেও এমডি অফিসে অফিসার পদে নিয়োগ দেন।

ছাঁটাইয়ের নামে অর্থ আদায়ের অভিযোগ

ঢাকা প্ল্যান্টে ফেব্রুয়ারিতে ১২৫ জন ক্যাজুয়াল কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়, যার মধ্যে ৩০ জনকে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় এমডির পিএস নাজমুল হুদা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা তুষারসহ একাধিক কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিন্ডিকেট ও ক্ষমতার অপব্যবহার

ইডিসিএলের প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারি, অনিয়মিত নিয়োগ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতির অভিযোগ। তাকে সহায়তা করছে খুলনা ল্যাটেক্স প্লান্টের উপ-ব্যবস্থাপক কাজী তানজীমা তাবাচ্ছুম, যার বিরুদ্ধে ওভারটাইমসহ আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খুলনা প্লান্টে কর্মচারী নিয়োগ, চাকরি স্থায়ীকরণ ও ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেন চলছে বলে অভিযোগ কর্মীদের।

ফেসবুক পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব

এক প্রবাসী সাংবাদিক জানান, ইডিসিএলের এমডি সামাদ মৃধা তাকে ফোন করে ফেসবুক পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে তার চাওয়া অনুযায়ী কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব দেন।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করছে

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব মোজাম্মেল হোসেন খান বলেন, “নিয়োগ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পাওয়ায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান জানান, “ইডিসিএলে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগের সুযোগ আর নেই। যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সংক্ষেপে: দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মে জর্জরিত ইডিসিএলে সরকার পরিবর্তনের পরও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। নতুন এমডি নিয়োগের পর আশা করা হলেও, প্রতিষ্ঠানটি আবারও নিয়োগ বাণিজ্য, আত্মীয়প্রীতি ও ছাঁটাই নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। তদন্ত কমিটির কার্যক্রমের ফলাফলেই নির্ধারিত হবে, আদৌ এই প্রতিষ্ঠানটি কোনদিন সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে কি না।

এই প্রতিবেদনটি পেশাগতভাবে উপস্থাপনযোগ্য, তথ্যনির্ভর এবং সাংবাদিকতার নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে। আপনি চাইলে এটিকে সংক্ষিপ্ত, রিপোর্ট আকারে বা ধারাবাহিক অনুসন্ধান রিপোর্ট হিসেবে সাজিয়ে দিতে পারি।

Exit mobile version