26.9 C
Khulna
Monday, July 7, 2025

আবু সাঈদ শহীদ হলে সিদ্ধান্ত নিই, রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। ফ্যাসিবাদী দমননীতি ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের সময় তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বন্দি থাকা অবস্থায় ট্রমার মধ্য দিয়েই পার করেছেন অনেকদিন।

আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাসনাত জানান, ৯ জুলাই শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি, যা চলে দুই দিন। এরপর সমন্বয়করা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। তিনি নিজে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেন।

১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার পর, সেদিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা এক প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বংশধর বলে আখ্যায়িত করলে ঢাবির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। রাতে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!” স্লোগানে ঢাকা কেঁপে ওঠে। হলগুলো থেকেও ছাত্রীরা রাজপথে যোগ দেয়।

ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশি নির্যাতন

১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে কর্মসূচির পর বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। ওবায়দুল কাদের বলেন, “এই আন্দোলন দমন করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।” হামলায় হাসনাত আহত হন, বাঁ পায়ে জখম হয়। আন্দোলনের শুরু থেকেই পুলিশ শাহবাগে হাসনাত ও অন্যান্য নেতাদের তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।

১৬ জুলাই রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেয়, “রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়।” ১৭ জুলাই ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা চলাকালে পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। ভিসি চত্বরে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সংলাপের নাটক ও নিরাপত্তা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী নওফেল ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত সংলাপের আহ্বান জানালে আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। তারপর হাসনাত ও তার সহযোগীদের জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে একপর্যায়ে তাদের ‘সেইফ হোমে’ রাখা হয়, যেখানে জুমার নামাজ পড়তেও দেওয়া হয়নি।

হাসনাত জানান, তাকে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং এক পর্যায়ে কিচেনে নিয়ে গিয়ে থাপ্পড় মারা হয়। বলা হয়, তার পরিবারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। এরপরও আন্দোলনের অবস্থান থেকে তারা সরে আসেননি।

নির্যাতনের চূড়ান্ত পর্যায়

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রেস কনফারেন্সের দিনও তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী হাসনাত, সারজিস ও নাহিদকে সাইন্সল্যাব এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং সারা শহর ঘুরিয়ে তাদের এক অচেনা অফিসে নেয়। সেখানে দিন-রাত বসিয়ে রাখা হতো, বাথরুম ব্যবহারেও সীমাবদ্ধতা ছিল। খাবার দেওয়া হতো অনিয়মিতভাবে এবং কোনো সংবাদমাধ্যম বা যোগাযোগের সুযোগ রাখা হয়নি।

একদিন গার্ডিয়ানকে ডাকা হলেও তাকে রাত পর্যন্ত বসিয়ে রেখে জানানো হয়, ‘কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি’।

উপসংহার

হাসনাত আবদুল্লাহর বর্ণনায় উঠে এসেছে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের ভেতরকার তীব্র দমননীতি, মানসিক নির্যাতন এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বাস্তব চিত্র। এই সাক্ষ্য শুধু একটি ব্যক্তির নয়—বরং একটি প্রজন্মের স্বাধীনতা ও ন্যায়ের দাবিতে শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দলিল।

- Advertisement -spot_img

More articles

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ