প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫
প্রার্থী মনোনয়নে জামায়াতে ইসলামীতে অতীতে কখনোই অসন্তোষ, কোন্দল দেখা না গেলেও এবারের নির্বাচনে ক্যাডারভিত্তিক এ দলে তা দেখা গেছে। চারটি আসনে বিরোধ হয়েছে প্রকাশ্যে। আরও চারটি আসনে অপ্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলে প্রার্থী মনোনয়নে সংঘর্ষ, বিরোধ সাধারণ ঘটনা হলেও জামায়াতে আগে তা দেখা যায়নি । রুকন (সদস্য), কর্মী, সহযোগী সদস্য– এই তিন স্তর আছে জামায়াতে। সংসদ নির্বাচনে দলটিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের ভোটে প্রার্থী বাছাই করা হয়। এটি অনুমোদন করে কেন্দ্র। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও জামায়াত দলীয়ভাবে যে প্রার্থীকে সমর্থন করেছে, নেতাকর্মীরা তাকেই মেনে নেন। এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
এবার পাবনা-৫ (সদর), ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া), কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে প্রকাশ্য বিরোধ, প্রার্থীকে লাঞ্ছনা ও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা এবং বিক্ষোভ দেখা গেছে। নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে তৃণমূলের আপত্তিতে প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট-৫, কুষ্টিয়া-৩, চট্টগ্রাম-১৫, গাজীপুর-৬ আসন নিয়ে অপ্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে। কুমিল্লার দুটি আসনেও অসন্তোষের গুঞ্জন রয়েছে।
নিজেদের সুশৃঙ্খল দাবি করা জামায়াতে কেন বিরোধ দেখা যাচ্ছে– এ প্রশ্নে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, সমর্থক পর্যায়ের কিছু লোক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করেছে। তারা দলীয় শৃঙ্খলা সম্পর্কে ততটা ভালো জানেন না। তবে জামায়াত এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রুকন পর্যায়ের কোনো জনশক্তি এসব তৎপরতায় জড়িত নয়।
প্রকাশ্য বিরোধ-দ্বন্দ্ব
ময়মনসিংহ-৬ আসনে মনোনয়ন না পাওয়া সাবেক জেলা আমির অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের সব সাংগঠনিক পদ স্থগিত করা হয়েছে। রুকনিয়াতও স্থগিত করা হয়েছে। ২০০১ সালে এই আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন। এবারের নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
এ আসনে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী জেলার নায়েবে আমির অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলন। তাঁর নাম ঘোষণার পর জসিম উদ্দিনের সমর্থক ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল থেকে কামরুল হাসান মিলনকে ফুলবাড়ীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন করার কথা বললেও সাংগঠনিক পদ স্থগিত হওয়ার পর জসিম উদ্দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। কামরুল হাসান মিলন সমকালকে বলেছেন, নেতাকর্মী সবাই ভোটের প্রচারে ঐক্যবদ্ধ। যে দুই-একজন এখনও সক্রিয় নন, তারাও নির্বাচনের সময় দলের পাশে থাকবেন।
গত ২৭ অক্টোবর কুমিল্লার চান্দিনায় উত্তর জেলা জামায়াতের গণমিছিলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এমনটি অতীতে কখনও দেখা যায়নি। একটি পক্ষের ভাষ্য, জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের দোসর। সেদিন বক্তৃতা করার সময় মাইক কেড়ে নিয়ে জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ ‘দল বিক্রি চলবে না, আওয়ামী দোসর প্রার্থী মানি না’ স্লোগান দেয়।
স্থানীয় জামায়াত সূত্র জানায়, ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি মোস্তফা শাকের উল্লাহ তৃণমূলের ভোটে প্রার্থী মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু জেলার নেতারা তা বদলে ফেলেছেন বলে তাদের অভিযোগ। ২৭ অক্টোবর বিক্ষোভের সময় জেলা আমির ও সেক্রেটারির বিরুদ্ধেও স্লোগান দেওয়া হয়।
চান্দিনা উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাজিদ আল-আমিন বলেন, জেলা আমির ও সেক্রেটারি অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে মোশাররফ হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।
যদিও মোশাররফ হোসেন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ শাসনামলে সরকারি কার্যক্রমে স্থানীয় এমপিদের অনুষ্ঠানে যেতে হতো। সেই ছবি সামনে এনে একটি পক্ষ দোসর বলছে। তারা নির্বাচনের মাঠে নেই।
জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা সমকালকে বলেন, চান্দিনার ঘটনাটি উদ্বেগের। দলের ৮৪ বছরের ইতিহাসে এমন বিশৃঙ্খলা হয়নি। এ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। শাকেরকে তরুণদের একটি অংশ প্রার্থী হিসেবে চাইছে। কিন্তু প্রার্থী বদল করা হবে না। এতে খারাপ বার্তা যাবে।
এর আগে পাবনা-৫ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা ইকবাল হোসেনকে বাদ দেওয়ার জন্য বিক্ষোভ করে স্থানীয় জামায়াতের একাংশ। তারা জামায়াতের তিনবারের এমপি আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য আব্দুর রহিমকে প্রার্থী করার দাবি জানান। স্থানীয় নেতাদের একাংশের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন ইকবাল হোসেন। তিনি জামায়াতের প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন।
অসন্তোষ কিছু আসনে
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) আসনে ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে জয়ী হন শাহজাহান চৌধুরী। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি দণ্ডিত হওয়ায় ২০০৮ সালে নির্বাচন করে জয়ী হন আ ন ম শামসুল ইসলাম। ২০১৮ সালেও প্রার্থী হন জামায়াতের এই নায়েবে আমির। এবার অন্যান্য আসনে গত জানুয়ারি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা শুরু হলেও জামায়াতের ঘাঁটিখ্যাত চট্টগ্রাম-১৫ আসনে শাহজাহান চৌধুরীকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয় গত জুনে। অন্যদের নাম জেলা থেকে ঘোষণা করা হলেও এ আসনের ক্ষেত্রে সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার চট্টগ্রাম গিয়ে নাম ঘোষণা করেন। জামায়াত বিরোধের কথা অস্বীকার করলেও শাহজাহান চৌধুরীর ভোটের প্রচারে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গত জানুয়ারিতে দলের মজলিসে শূরা সদস্য ফরহাদ হুসাইনের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু মে মাসে তাঁকে বাদ দিয়ে ওয়াজের বক্তা আমির হামজার নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ভারতের চিত্রনায়িকাদের রূপ বর্ণনাসহ ওয়াজে উদ্ভট সব তথ্য দিয়ে বিতর্কিত আমির হামজা ৫ আগস্টের আগে নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সদস্য দাবি করেছেন। শেখ হাসিনাকে ১৬ কোটি জনগণের জননী আখ্যা দেন। দল নির্দেশ দেয় তাঁকে মুখ বন্ধ রাখতে। এর পর থেকে তিনি চুপ। স্থানীয় সূত্রের খবর, স্থানীয় জামায়াতের একাংশ তাঁর পক্ষে নেই। ভোটের প্রচারে আমির হামজার পাশে নেই বাদ পড়া ফরহাদ হুসাইন।
সিলেট-৫ আসন নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে স্থানীয় জামায়াতে। ১৯৯৬ সালে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত জামায়াতের ফরিদউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ সালে এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এবার তাঁর বদলে আনোয়ার হোসেন খানকে প্রার্থী করা হচ্ছে। শিবিরের সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতা সমকালকে বলেন, স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় কিংবা প্রভাবশালী নন এই প্রার্থী। তাঁকে সবাই গ্রহণ করবে না। এ কারণে জয়ের সব রকম সম্ভাবনা থাকার পরও এ আসন জামায়াত হারাতে পারে ঐক্য না থাকায়।
আসন পুনর্বিন্যাসে নবগঠিত গাজীপুর-৬ আসনে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী ড. হাফিজুর রহমান। তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা এ নেতা বিদেশ থেকে সরাসরি এসে প্রার্থী হয়েছেন কেন্দ্রের পছন্দে।
স্থানীয় জামায়াত সূত্রের ভাষ্য, দলীয় নিয়ম অনুযায়ী তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়নি। হঠাৎ আসা প্রার্থীকে মাত্র তিন মাসে পরিচিত করে নির্বাচনে লড়াইয়ের যোগ্য করা যাবে কিনা– সংশয় রয়েছে। তাই স্থানীয় প্রার্থী চেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু কেন্দ্র এ দাবি শোনেনি।
ns/samakal